জেলা সৃষ্টির ইতিহাস/পটভূমিঃ
বাংলাদেশের অন্যতম জনবহুল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রবেশদ্বার ও জেলা সমূহের অন্যতম এই ঝিনাইদহ। ঝিনাইদহ এক সমৃদ্ধ জনপদ। মরমী কবি লালন শাহ্, পাগলা কানাই, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান, বীরপ্রতীক সিরাজুল ইসলাম, বিপ্লবী বীর বাঘাযতীন, গণিত শাস্ত্রবিদ কে.পি.বসু, কবি গোলাম মোস্তফা, বারো আউলিয়ার আর্শীবাদপুষ্ট বারোবাজার, গাজী-কালূ-চম্পাবতির উপাখ্যান, কুমার-কপোতাক্ষ, চিত্রা, বেগবতী, নবগঙ্গাঁ নদী আর খেজুর গুড়, কলা-পানের প্রাচুর্য মন্ডিত এই ঝিনাইদহের রয়েছে সুপ্রাচীন ঐতিহ্য।
ছবিঃ সাবেক মহকুমা ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়
ঝিনাইদহ জেলাটি গঙ্গাঁর দুই শাখা নদী পদ্মা ও ভাগীরথীর সংযোগে গঠিত গাঙ্গেঁয় বদ্বীপের অংশ বিশেষ বলে জানা যায়। টলেমির মানচিত্রে গাঙ্গেঁয় বদ্বীপের দক্ষিণাংশে নদী-নালা পরিবেষ্টিত যে ভূমির অস্তিত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। ঝিনাইদহের আদি বসতি সেখানেই গড়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় খৃষ্টাব্দের গোড়ার দিকে এর অস্তিত্ব ছিল।
প্রাচীন যুগেও বিভিন্ন শাসনামলে ঝিনাইদহের স্থায়ী জনবসতি এবং সংগঠিত সমাজ ব্যবস্থার অস্তিত্বের ইংগিত পাওয়া যায়। ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে ঝিনাইদহ অঞ্চলটি বঙ্গ তথা সমতট রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। এই জেলায় ১৩টি নদী, ২৯টি বাওড়, ৪২টি বিলসহ অসংখ্য নদ-নদী, হাওড়, বিল-বাওড় এর অস্তিত্ব ছিল এবং এর প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল নদী পথ। এই নদী পথের পাশেই শহর-বন্দর ও ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল যার অস্তিত্ব এখনও বহন করছে। গড়াই, কালী, ডাকুয়া ও কুমার নদের পাড়ে শৈলকুপা, কপোতাক্ষ নদের পাড়ে কোটচাঁদপুর, চিত্রা নদীর পাড়ে কালিগঞ্জ, কোদলা, ইছামতি, বেতনা নদীর মাঝে মহেশপুর ও নবগঙ্গা পাশ্ববর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা নদী থেকে জন্ম নিয়ে নবগঙ্গা নদী হরিণাকুন্ডু ও ঝিনাইদহের বুক চিরে প্রবাহিত হয়ে চলে গেছে মাগুরার দিকে। এই নবগঙ্গাঁ নদীর তীরে গড়ে উঠেছে ঝিনাইদহ জেলা শহর। পূর্বের মহকুমা প্রশাসক ও বর্তমান জেলা প্রশাসকের বাংলোটি আসলে জেলখানার জেলারের কোয়ার্টার ছিল। মহকুমা প্রশাসকের বাংলো নবগঙ্গা নদী গর্ভে বিলীন হলে জেলারের এই কোয়ার্টারকে মহকুমা প্রশাসকের বাংলো করা হয়।
ছবি- বর্তমান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়
১৭৫৭ সালের পর ১৭৮১ সালে ঝিনাইদহ সরাসরি ইংরেজ শাসনের অধীনে চলে যায়। এই বছরই যশোরের মুরলীতে ইংরেজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তাদের অফিস বা কোর্ট স্থাপন করে।
যশোর, খুলনা, ফরিদপুর জেলাকে এর অধীনে আনা হয়। ওই কোর্টের প্রথম জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিযুক্ত হন টিলম্যান হেংকল। ওই সময় ইংরেজরা জবরদস্তিমূলকভাবে ঝিনাইদহে নীলচাষে কৃষকদের বাধ্য করে। কৃষকদের চরম দুর্গতি এবং তাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন শুরু হলে নীল বিদ্রোহ শুরু হয়। পরিশেষে নীল চাষ বন্ধ হয়।
ওইসব ঘটনার ফলে ইংরেজ আমলে ১৭৯৩ সালে প্রথমে ঝিনাইদহে পুলিশ ফাঁড়ি। পরবর্তীতে থানা এবং ১৮৬০-৬১ সালের দিকে ঝিনাইদহ প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে মহকুমা প্রতিষ্ঠা করা হয়।
Time Publication এর Bangladesh Dictionary 1978-তে -এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- "Jessore has undergone a long series of changes with regard to its area. In 1860-61 separate sub-division were created with headquarters at Khulna, Jhenaidah, Magura, Narail and Jessore"
অন্য একটি সরকারী তথ্যে বলা হয় ‘‘The Sub-division was latter abolished in the rearrangement made in 1863.
অপর আর একটি সূত্র মতে, ১৮৬২ সালে ঝিনাইদহ মহকুমা পর্যায়ে উন্নীত হয়। ঝিনাইদহ মহকুমা হলে ১৮৬৩ সাল তৎকালীন সময়ের বাণিজ্য নগরী বলে খ্যাত কোটচাঁদপুর মহকুমা বিলূপ্ত হয়ে যায়। বর্তমানে কোটচাঁদপুর ঝিনাইদহের একটি থানা ও উপজেলা শহর।
১৮৬৩ থেকে ১৯৪৭ সালের পাকিস্থান আমল এবং স্বাধীন বাংলাদেশের এক দশক পর্যন্ত প্রশাসনিক কাঠামো হিসেবে ঝিনাইদহে মহকুমা বিদ্যমান ছিল। প্রথম মহকুমা প্রশাসক ছিলেন জনাব বি. এলেন ও শেষ মহকুমা প্রশাসক ছিলেন জনাব মোহাম্মদ শফিউল করিম। এর পর ১৯৮৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ জেলায় উন্নীত হয়। প্রথম জেলা প্রশাসক ছিলেন জনাব জেড, এম, রফিক ভুঁঞা।
তথ্যের উৎসঃ
১. ঝিনেদার ইতিহাস
২. ঐতিহ্যবাহী ঝিনাইদহ
ঝিনাইদহ জেলা পরিচিতিঃ
নামকরনঃ
প্রাচীনকালে বর্তমান ঝিনাইদহের উত্তর পশ্চিম দিকে নবগঙ্গাঁ নদীর ধারে ঝিনুক কুড়ানো শ্রমিকের বসতি গড়ে ওঠে বলে জনশ্রুতি আছে। সে সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গেঁর কোলকাতা থেকে ব্যবসায়ীরা ঝিনুকের মুক্তা সংগ্রহের জন্যে এখানে ঝিনুক কিনতে আসতো। সে সময় ঝিনুক প্রাপ্তির এই স্থানটিকে ঝিনুকদহ বলা হতো। সে সময় ঝিনুক থেকে মুক্তা সংগ্রহের মাধ্যমে এবং ঝিনুক পুড়িয়ে চুন তৈরী করে তা বিক্রি করে মানুষ অর্থ উপার্জন করতো।
অনেকের মতে ঝিনুককে আঞ্চলিক ভাষায় ঝিনেই, ঝিনাই এবং দহ অর্থ বড় জলাশয় ও ফার্সি ভাষায় দহ বলতে গ্রামকে বুঝানো হতো। সেই অর্থে ঝিনুকদহ বলতে ঝিনুকের জলাশয় অথবা ঝিনুকের গ্রাম বুঝাতো। আর এই ঝিনুক এবং দহ থেকেই ঝিনুকদহ বা ঝিনেইদহ, যা- রূপান্তরিত হয়ে আজকের ঝিনাইদহ নামকরন হয়েছে।
অন্য কিংবদন্তি থেকে জানাযায়, এক ইংরেজ সাহেব এই এলাকা দিয়ে নৌকাযোগে নবগঙ্গাঁ নদী পর হচ্ছিলেন। অনেক লোকজন তখন নদী থেকে ঝিনুক সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত ছিল। উপস্থিত লোকদের কাছে সাহেব তখন এলাকাটির নাম জানতে চান। লোকেরা তার কথা বুঝতে না পেরে ভেবে নেন যে নদী থেকে তারা কি জিনিস তুলছে তার নাম জানতে চাচ্ছেন। এই মনে করে লোকেরা সাহেবকে বলেন ঝিনুক বা ঝিনেই। এতে ইংরেজ সাহেব ধরে নেন জায়গাটির নাম ঝেনি। এই ঝেনি শব্দটি পরে ঝেনিদা হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ঝিনাইদহকে আঞ্চলিক ভাষায় এখনও ঝিনেদা বলা হয়। ঝেনিদা, ঝিনেদা আর ঝিনাইদহ যাই বলা হোক না কেন ঝিনাইদহ নামের উৎপত্তি যে ঝিনুক থেকে তা এ অঞ্চলের মানুষের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য।
ঐতিহ্যবাহী ঝিনাইদহ গ্রন্থে ঝিনাইদহ সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘‘বারো আউলিয়ার আর্শীবাদপুষ্টঃ গাজী-কালূ-চম্পাবতীর উপখ্যানধন্য; কে.পি. বসু, গোলাম মোস্তফার স্মৃতি বিজড়িত; বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান, বিপ্লবী বীর বাঘাযতীনের শৌর্যময়; খেজুর গুড়, কলা-পানের প্রাচুর্যমন্ডিত; পাগলাকানাই, লালন শাহের জম্মস্থান, কপোতাক্ষ, বেগবতী, চিত্রা, নবগঙ্গাঁর ঝিনুকদহ এক কথায় নাম তার ঝিনাইদহ।’’
ঝিনাইদহের নামকরনের ন্যায় এর অপর ৫টি উপজেলারও রয়েছে নাম করনের বৈচিত্রময় ইতিহাস।
শৈলকুপাঃ
শৈলকুপার কুমার নদীতে একসময় নাকি প্রচুর পরিমানে শৈলমাছ পাওয়া যেত এবং তা সাধারণ কুপিয়ে মারা হতো। এজন্যেই এর নাম হয় শৈলকুপা। আবার অন্যদের মতে এখানে শৈলগুল্প বেশী থাকার কারনে এ অঞ্চলকেব শৈলকুপা নামে অভিহিত করা হয়। শৈলকুপা বহু পূর্বে ফরিদপুর জেলার মধ্যে ছিল।
মহেশপুরঃ
ভৈরবের তীরে অবস্থিত মহেশপুর উপজেলার আদিনাম যোগীদহ। পরবর্তীতে ১১০৭ সালে হিন্দু দেবতা মহেশপুর ঠাকুরের মন্দির প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আদিনাম পরিবর্তিত হয়ে মহেশপুর হয়। কেউ কেউ বলেন রাজা মহেশ চন্দ্রের নামানুষারে এলাকার নাম মহেশপুর হয়। অন্য জনশ্রুতি হল ঐ অঞ্চলের রাজত্ব এক জেলে রাজার হস্তগত হলে তার ছেলে ‘‘মহেশ’’ এর নামানুষারে মহেশপুর নামকরন হয়। মহেশপুর ভারতের বনগাঁও মহাকুমার একটি অন্যতম অংশ ছিল। ১৯৪৭ সালে মহেশপুর ঝিনাইদহ মহাকুমার অন্তর্গত হয়। মহেশপুরকে খাদ্যভান্ডার বা রত্নভান্ডার বলা হয়।
কালীগঞ্জঃ
কালীগঞ্জ উপজেলার নামকরনের পিছনে জনশ্রুতি আছে তা হলো এই বাজারে বিখ্যাত কালিমন্দিরকে অবলম্বন করেই কালীগঞ্জ নাম করন হয়।
কোটচাঁদপুরঃ
জনশ্রুতি আছে, জঙ্গলে ঘেরা এ অঞ্চলে চাঁদফকির নামের এক দরবেশ আস্তানা গড়েন। তার নামে এর নাম হয় চাঁদপুর। মোঘল আমলে ১৬১০ সালে একটি কোর্ট নির্মিত হয়। আর চাঁদপুর নামের আগে কোট শব্দটি বসিয়ে এর নাম হয় কোটচাঁদপুর। বৃটিশ আমলে এখানে কোর্ট ছিল এবং ১৮৬২ সাল পর্যন্ত এটি মহাকুমা বাণিজ্য নগরী হিসেবে খ্যাত ছিল।
হরিণাকুন্ডুঃ
লোকমুখে প্রচার আছে ‘‘অভয়কুন্ড নামে এক ইংরেজ কর্মচারীর অত্যাচারী পুত্র হরিচরন কুন্ডুর নামানুষারে এ অঞ্চলের নাম হয় হরিণাকুন্ডু ।
ঝিনাইদহের প্রাচীন ইতিহাস
ঝিনাইদহ একটি প্রাচীন জনপদ। অসংখ্য কিংবদন্তি, ঐতিহাসিক ঘটনাবলি ও তথ্যাবলীতে সমৃদ্ধ। এই জনপদের সুদীর্ঘ গৌরবময় ইতহাসও অতিপ্রাচীন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধসহ সমসত্ম আন্দোলনে এ জেলার মানুষের রয়েছে গর্ব করার মত অবদান। শিক্ষা, সংস্কৃতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, উর্বর ভূমি এসবই স্রষ্ঠার শ্রেষ্ঠ দান হিসেবে জেলাবাসী মনে করে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব, কৃষি-মৎস্য, প্রত্নতত্ব ও ভৌগলিক অবস্থানের দিক দিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এই জেলাটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান অধিকার করে আছে এবং অনেক পূর্ব থেকে এটি সমৃদ্ধি অর্জন করেছে।
ঝিনাইদহ অঞ্চলটি দূর অতীতে তমাশাবৃত, জঙ্গলাকীর্ণ ও কেয়াবন আচ্ছাদিত ছিল। এসময় অঞ্চলটি সুন্দরবনের বর্ধিতাংশ বলে গণ্য হতো। অনেকে এ অঞ্চলকে সুর্যদ্বীপ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন।
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের পর ইরান-ইরাক-তুরষ্ক ও আফগানিস্থান থেকে অনেক সুফী দরবেশ, পীর-আউলিয়া ধর্ম প্রচারের জন্য ঝিনাইদহে আসেন। তারা এ অঞ্চলের কালীগঞ্জ, বারোবাজার, কোটচাঁদপুর, মহেশপুর সহ বিভিন্ন এলাকায় ধর্ম প্রচারের সাথে সাথে আবাস গড়ে তোলেন। জেলার বারোবাজার, শৈলুকপা, কোটচাঁদপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের নির্মিত মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপত্যের নিদর্শন আজও পাওয়া যায়।
প্রখ্যাত সাধক মরমী কবি লালন সাঁই, পাগলা কানাই, গণিত বিদ কে.পি. বসু, কবি গোলাম মোসত্মফার জন্মস্থান ঝিনাইদহ। বিপস্নবী বাঘা যতীন, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ও বীর প্রতীক সিরাজুল ইসলামের বীরত্বগাঁথা এবং ৭১’র স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের প্রথম সম্মুখ যুদ্ধের জেলা ঝিনাইদহ। গাজী-কালু-চম্পাবতীর উপাখ্যানখ্যাত হাওড়, বাওড়-নদী-কলা-পান, খেজুর গুড়, ধান-ফসলের প্রাচুর্যে ভরা খাদ্য ভান্ডার এই ঝিনাইদহ।
প্রাচীন যুগের বিভিন্ন শাসনামলে ঝিনাইদহে স্থায়ী জনবসতি ও সু-সংগঠিত সমাজ ব্যবস্থার ইংগিত পাওয়া যায়। খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতকে ঝিনাইদহ বঙ্গঁ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল বলে ধারণা করা হয়। ষষ্ট শতকে গুপ্ত রাজ্যের অধীন এবং ঐ শতকের মধ্যভাগে বঙ্গঁগুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন হলে বাংলা বঙ্গঁ বা সমতট এবং গৌড় এই দুটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ঝিনাইদহ অঞ্চলটি বঙ্গঁতথা সমতট রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ৭ম শতকে গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক এবং শশাঙ্কের মৃত্যুর পর সম্রাট হর্ষবর্ধনের অধীনে শাসিত হয়। ৭২৫-৭৩৫ খ্রীষ্টাব্দ সময়কালে কনৌজর রাজা যশোবর্ধন গৌড় ও বঙ্গঁ রাজ্য অধিকার করে নিলে ঝিনাইদহসহ সমগ্র বাংলা তার অধীনে চলে যায়। ৭৮১-৮২১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ঝিনাইদহ পাল রাজবংশের অন্তর্গত ছিল। পল বংশের পতনের পর ১০৮০-১১৫০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যস্ত বর্মণরা ঝিনাইদহ অঞ্চল শাসন করে। ১১৫০ সালে বর্মণ রাজবংশ সেন রাজবংশের কাছে পরাজিত হলে ঝিনাইদহ সেন রাজ বংশের কর্তৃত্বে চলে যায়। ১২০৪ সালে বখতিয়ার খলজি বঙ্গঁ বিজয়ের পর ১২৬৮ থেকে ১২৮১ পর্যমত্ম ঝিনাইদহ মুসলিম রাজ্য তথা দিল্লী সালতানাতের অধীনে লক্ষনাবতীর অন্তর্ভূক্ত হয়।
১৩৪২ সালে সুলতান শাসুদ্দিন ইলয়াস শাহ্ লক্ষনাবতীকে স্বাধীন সালতানাত ঘোষণা করে বাংলাকে একটি প্রশাসনিক কাঠামোতে আনেন। তাঁর আমলে মুসলিম শাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবর্তন আনা হয়। সেসময় ঝিনাইদহ তার শাসনাধীনে ছিল। মুসলিম শাসনের হুসাইন শাহী আমলেও ঝিনাইদহের প্রশাসানিক কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। হুসেইন শাহী বংশের বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সুলতান গিয়াস উদ্দীন মহম্মদ শাহ্ (১৫৩২-১৫৩৮ খ্রীষ্টাব্দ) দিল্লীর পাঠান সুলতান শের শাহের নিকট পরাজিত হলে বাংলা দিল্লীর শাসনাধীনে চলে যায়।
১৫৩৯-১৫৫৩ পর্যন্ত ঝিনাইদহ পাঠান সুলতানদের দ্বারা শাসিত হয়। এরপর ১৫৭৬ সালে দাউদ করোনারীর আমলে বাংলায় মোঘল শাসনের সূচনা হয়। এর প্রায় ৩৬ বছর পর ঝিনাইদহ মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। সম্রাট আকবরের আমলে বারো ভূইয়াদের যশোরের এক রাজা ভূমি রাজস্ব আদায়সহ ঝিনাইদহে শাসন কার্য পরিচালনা করতে থাকেন। এসময় রাজা প্রতাপাদিত্য মোঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে ১৬১২ সালে মোঘল সেনাপতি তাকে পরাজিত করে। এইসময় মোঘল আমলে ঝিনাইদহে ভূমি রাজস্ব স্তর ও ফৌজদারীসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।
সম্রাট শাহজাহানের আমলে যশোরে একটি পৃথক ফৌজদারি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং ঝিনাইদহ ঐ ফৌজদারীর অন্তর্ভুক্ত হয়। মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনে বাংলার রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা প্রাপ্ত সুবাদার মুর্শিদ কুলি খাঁর আমলে ১৭০৩ খ্রীষ্টাব্দের পর সীতারাম রায় নামক একজন ভূ-স্বামীর আবির্ভাব ঘটে এবং ঝিনাইদহের শাসনভার তার হাতে চলে যায়। সীতারামের পতনের পর ১৭১৪ খ্রীষ্টাব্দে যশোর ফৌজদারী চাচড়া, নলডাঙ্গা ও মহম্মদ শাহী এই ৩টি জমিদারির মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। ঝিনাইদহ নলডাঙ্গা ও মহম্মদ শাহী জমিদারীর আওতায় ছিল। এ দু’জমিদারীর প্রশাসনিক কাঠামোর চিহ্ন ঝিনাইদহে আজো রয়েছে।
১৭৫৭ সালের ২৩জুন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর বেতনভূক্ত সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ এর কাছে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা পরাজয় বরণের ফলে বাংলা ও ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত ঘটে। ১৮৮১ সালে ঝিনাইদহ ইংরেজ শাসনের আওতায় আসে। ওই সময় ইংরেজ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী যশোরের মুরলীতে একটি অফিস বা কোর্ট স্থাপন করেন। বৃহত্তর যশোর, খুলনা, ফরিদপুর জেলাকে ওই কোর্টের অধীনে আনা হয়। এই কোর্টের ১ম জর্জ ও ম্যাজিষ্ট্রেট নিযুক্ত হন ইংরেজ টিলম্যান হেংকেল। ইংরেজরা ঝিনাইদহের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষীদের ওপর চাপিয়ে দেয় নীল চাষ। ঝিনাইদহের খালিশপুর, বিজুলিয়া, বাঘাডাঙ্গা, সাধুহাটি সহ বিভিন্ন স্থানে নীল কুটি স্থাপন করা হয়। নির্যাতিত চাষীদের নীল বিদ্রোহের ফলে ১৮৬০ সালে নীল কমিশন গঠন হয় ও নীল চাষ বন্ধ হয়। নীল বিদ্রোহে ঝিনাইদহের কৃষকরা বাঁশ কেটে সুচলো করে লোহার ফালা লাগিয়ে চেঙ্গা জোরে ছুড়ে সাহেবদের ঘায়েল করতো।
ঝিনাইদহের রয়েছে বীরত্বগাথা ইতিহাস। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝিনাইদহের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েন। এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল সদর উপজেলার বিষয়খালিত। প্রায় ৩ ঘন্টা তুমুল যুদ্ধের পরও ব্যর্থ হয়ে পাকিস্থানী সেনাদল পিছু হটে যায়। সারা জেলায় মুক্তিযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধ শেষে ৩ ডিসেম্বর মহেশপুর, ৪ ডিসেম্বর কোটচাঁদপুর, ৫ ডিসেম্বর কালিগঞ্জ ও ৬ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ শহরস্থ সমগ্র জেলা স্বাধীন হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে সারা জেলায় ১৭৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীন হন।
জেলার শৈলকুপা থানা একসময় ফরিদপুর জেলার মধ্যে এবং মহেশপুর বনগাঁ মহাকুমার মধ্যে ছিল। ১৯৪৭ সালে মহেশপুর বাদে বনগাঁ মহাকুমা ভারতের অংশ হয়ে যায়। মহেশপুরকে সে সময় অবিভক্ত যশোর জেলার খাদ্য ভান্ডার বলা হতো।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় এ জেলার রয়েছে ঐতিহ্য। ঝিনাইদহকে বলা হয় দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চেলর প্রবেশদ্বার। ১৯১৩-১৪ সালে ঝিনাইদহে রেলগাড়ি চলতো। জে.জে (যশোর-ঝিনাইদহ) রেল কোম্পানী গঠন করে রেলপথ নির্মিত হয়। রেলপথটিকে মার্টিন কোম্পানীর রেল পথ বলেও দাবী করা হয়ে থাকে। তখন আপ-ডাউন আটটি ট্রেন এ জেলায় চলাচল করতো। যশোর-ঝিনাইদহ ২৮ মাইল রাস্তার মধ্যে প্রসন্ননগর, কালীগঞ্জ, বারোবাজার ও চুড়ামনকাঠীতে রেলষ্ট্রেশন ছিল। এসময় কোটচাঁদপুরে চিনি শিল্প গড়ে ওঠায় কালীগঞ্জকে জংশন করে কোটচাঁদপুর পর্যন্ত ৮ মাইল রেল লাইন সম্প্রসারিত করা হয়। তখন রেলের ভাড়া ছিল ১ পয়সা। পরে ১৯৩৫-৩৬ সালে বাস সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। যশোর-ঝিনাইদহ বাস সার্ভিস চালু হয়।
তথ্যের উৎসঃ
১. ঝিনেদার ইতিহাস
২. ঐতিহ্যবাহী ঝিনাইদহ
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস